বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে দেশ কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারছে না। না আইন করে, না শাস্তি দিয়ে, না সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে—কোনোভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এই রেওয়াজটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। করোনা মহামারির দুই বছরে এই রেওয়াজটি আরো ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। অভিভাবকরা যেন কন্যাশিশুটিকে ‘হত্যার যুক্তি’ খুঁজে পেয়েছেন।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘বাংলাদেশে কভিড-১৯ মহামারির সময় বাল্যবিবাহ : একটি দ্রুত অধ্যয়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই তথ্য। গত রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারির প্রথম বছরে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের ২৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর মহামারির দ্বিতীয় বছরে বিয়ে হয়েছে ৩৪ শতাংশের। প্রতিবেদনে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী গ্রুপ বিবেচনা করার পেছনের যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, জরিপকালে ১৯ বছর বয়সী বেশ কিছু মেয়েকে পাওয়া গেছে, যাদের বয়স ২০২০ ও ২০২১ সালের শুরুতে ১৮ বছরের নিচে ছিল।
শুধু বর্তমান জরিপেই নয়, এর আগেও বেশ কিছু জরিপে একই রকম তথ্য উঠে এসেছে। কয়েক মাস আগে রাজশাহী জেলা শিক্ষা দপ্তর করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, মহামারির দুই বছরে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার এই মেয়েদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী, এই জেলায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পড়ুয়া সাড়ে ছয় হাজার শিশুর বিয়ে হয়েছে এই সময়ে। তালিকায় প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য থাকলে সেখানেও এমন চিত্র কমবেশি পাওয়া যেত বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে ১৩ শতাংশের মতো। প্রকাশিত অন্য এক খবরে জানা যায়, বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় ছয় শতাধিক কন্যাশিশুর বিয়ে হয়েছে গত দুই বছরে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। প্রায় একই ধরনের খবর পাওয়া যায় রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে।
এসব তালিকায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া অনেক মেয়ে রয়েছে, যাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের বয়স কত? ১২ থেকে ১৪ বছর হতে পারে। এই বয়সে একটি মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়াকে অনেকেই হত্যার শামিল অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন। কোনো সভ্য সমাজে এমনটা কল্পনাও করা যায় না।
অথচ আমাদের এখানে এমন অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। অনেক স্থানে মেয়েরা নিজেরাই প্রতিবাদী হচ্ছে। কিন্তু সমাজের কিংবা প্রশাসনের প্রতিবাদ কোথায়?
বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েদের এভাবে হারিয়ে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি। সুযোগ পেলে বাংলাদেশের মেয়েরাও যে অনেক কিছু করে দেখাতে পারে, শিক্ষা, খেলাধুলাসহ অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা তা প্রমাণ করেছে। ছেলেদের ফুটবল যখন কোনো কিনারা পাচ্ছে না, মেয়েরা তখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা পরিসরে শিখরে ওঠার সামর্থ্য দেখিয়েছে। তাই মেয়েদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসকারী ও জীবন ধ্বংসকারী বাল্যবিবাহ যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।