খুলনার কয়রা উপজেলা। নিয়মিত জোয়ার আসে। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় কিছুটা বর্ধিত জোয়ার হয়। পূর্ণিমার সময় গত রবিবার ভোরে তেমনি বর্ধিত জোয়ারে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চরামুখা এলাকায় কপোতাক্ষের বাঁধ ভেঙে যায়।
মুহূর্তে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ভেসে যায় প্রায় তিন হাজার বিঘা চিংড়িঘের। তলিয়ে গেছে আমনের বীজতলা। তাত্ক্ষণিকভাবে এলাকাবাসী ছুটে যায়। বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করে, কিন্তু পেরে ওঠেনি। এরপর এলাকায় মাইকিং করে বাঁধ মেরামত কাজে এলাকাবাসীকে যোগ দিতে বলা হয়। গত সোমবার ভোরে বাঁধের ভাঙা অংশে তিন হাজার মানুষ জড়ো হয়। ছয় ঘণ্টার একটানা চেষ্টায় বাঁধের ভেঙে যাওয়া ৩০০ মিটার এলাকার মেরামত সম্পন্ন হয়। বেদকাশির মানুষের সেই উদ্যম, সেই চেষ্টার তুলনা হয় না।
শুধু খুলনার কয়রায় নয়, গত পূর্ণিমার কারণে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারে দক্ষিণের অনেক জেলার উপকূলবর্তী নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে ১১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বরগুনার তালতলী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়ায় বাঁধ ভেঙে সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একইভাবে সেসব এলাকায় মানুষের বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। রান্না করতে না পেরে মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব তীব্র হয়েছে। পুকুর বা ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। জানা যায়, বরিশাল বিভাগের ২৩টি নদীর মধ্যে প্রধান ১০টি নদীর পানিই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে।
এর মধ্যে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভোলার খেয়াঘাট এলাকায় তেঁতুলিয়া নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার, দৌলতখান উপজেলায় সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি ৬৯ সেন্টিমিটার এবং তজুমদ্দিন উপজেলায় সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি ১০৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ঝালকাঠি জেলায় বিষখালী নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার, পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলায় বুড়িশ্বর/পায়রা নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার, বরগুনায় বিষখালী নদীর পানি ৪৩ সেন্টিমিটার, পাথরঘাটায় বিষখালী নদীর পানি ৭৫ সেন্টিমিটার, পিরোজপুরে বলেশ্বর নদের পানি দুই সেন্টিমিটার এবং উমেদপুরে কচা নদীর পানি ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকার অনেক নিচু অঞ্চল এবং বাঁধের বাইরে থাকা বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বব্যাপী এর ক্ষতিকর অভিঘাত এখন আর কোনো ধারণাগত বিষয় নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল ও দ্বীপদেশগুলো নোনা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলও এর ব্যতিক্রম নয়। গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায়, ৬ নম্বরে। আর বাংলাদেশে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের তিন কোটি মানুষ। তাদের রক্ষায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষজ্ঞ কমিটি নব্বইয়ের দশকে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো আরো উঁচু, আরো শক্ত করে নির্মাণের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই কাজটি আমরা আজও করতে পারিনি। এখনো জোয়ারের পানির ধাক্কায় এসব বাঁধ ভেঙে যায়। আমরা চাই উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষার উদ্যোগ আরো জোরদার করা হোক।