বাল্যবিয়েকে অভিশাপ হিসেবেই মনে করে আমাদের বর্তমান সমাজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এর পরও দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশ শীর্ষে। ইউনিসেফের এক জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। বাংলাদেশের বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের প্রতিবেদনে এ-ও জানানো হয়েছে, বিশ্বের বাল্যবিয়েপ্রবণ শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এখন ৫১ শতাংশ।
২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা ১৯৭০ সালের তুলনায় ৯০ শতাংশেরও বেশি কমেছে, তা সত্ত্বেও এখনো এই হার অনেক বেশি। বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশের বিয়ে হয়েছে তারা শিশু থাকা অবস্থায়ই। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়ের শিকার শিশুদের বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের ও গ্রামে বাস করে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অবিবাহিত মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় চার গুণ বেশি। চলমান কভিড-১৯ মহামারি এখন বাল্যবিয়ে বন্ধের অগ্রগতিকে আবারও পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার হুমকিতে ফেলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। এমনকি শিশুদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। অপুষ্টির শিকার শিশুদের হার কমেছে। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। শিশুশিক্ষায়, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার পরিধিও অনেক বেড়েছে। কিন্তু বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারছে না কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগেও যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। শুধু আইন করেই এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না, এর জন্য প্রয়োজন হবে ব্যাপক জনসচেতনতাও। বাল্যবিয়ে মেয়েটির জীবন কিভাবে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে, তা-ও জানাতে হবে মেয়েশিশুর অভিভাবকদের।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেছে, যেসব মা-বাবা মেয়েশিশুদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা মেয়েশিশুর বয়ঃসন্ধির শুরুতে যৌন নির্যাতনের ভয় অনুভব করেন। শিশুদের বিয়ে দেওয়া এক ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে বলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে না। আবার এটাও সত্য, অনেক বিবাহিত কিশোরী দৈহিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বা এসবের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের বাল্যবিয়ের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীর নিরাপত্তা কিছুতেই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নারী ও শিশুর অধিকার সুরক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ—সবখানেই সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে। আইনের প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ সচেতন হলে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে নারী, শিশুসহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষের নিরাপত্তা বাড়বে।
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন