বাংলাদেশে প্রতিবছরই ঈদুল আজহায় কোরবানি করা পশুর চামড়ার দাম বেশ কমে যায়। কিন্তু এ বছর যা ঘটে গেল, তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ দেশে কোরবানির গরুর একটি চামড়া, তা যত ছোট আকারেরই হোক না কেন, কখনো ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়নি। এবার
তা-ই হয়েছে। ছাগলের একটি চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ২ টাকায়। ক্ষোভ-হতাশা থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ চামড়া নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে।
গত বছরও দাম কমের ক্ষোভ থেকে অনেক কোরবানির পশুর চামড়া গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলা এবং ফেলে দেওয়ার খবরে দেশজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সে সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘চামড়া নিয়ে এবার আমার শিক্ষা হয়েছে। এবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হবে না।’ দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ বছর কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া নিয়ে আরও বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ বাণিজ্যমন্ত্রীর সেই সব কথা নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে।
সরল বিবেচনায় মনে হতে পারে, ঈদুল আজহায় মূলত এক দিনে বিপুলসংখ্যক পশু কোরবানি হওয়ার কারণে খুব স্বল্প সময়ে চাহিদার
তুলনায় সরবরাহ বিপুলভাবে বেড়ে যায়, এবং তার ফলে বাজারের স্বাভাবিক নিয়মেই চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটে, তা সংঘবদ্ধ অপরাধ। এ বছরের কোরবানির পশুর চামড়া অনেকটা পানির দামে বিক্রি হওয়ার কারণ কিছু পশুচামড়ার আড়তদার ও ট্যানারির মালিকদের অন্যায় যোগসাজশ।
ঈদের সপ্তাহখানেক আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করে দেয় ঢাকায় ৩৫-৪০ টাকা; ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা। কিন্তু চামড়া বিক্রি হয়েছে স্থানবিশেষে সরকার–নির্ধারিত দামের অর্ধেক দামে এবং অর্ধেকের কম দামে। সরকার–নির্ধারিত দামের হার অনুযায়ী যে চামড়ার মূল্য হওয়ার কথা ৬৪০ টাকা, তা বিক্রি হয়েছে কোথায় ৩০০ টাকায়, কোথাও ৩৫০ টাকায়।
সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেই দাম কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা যোগসাজশ করে সরকার–নির্ধারিত দামের অর্ধেকেরও কম দামে চামড়া কেনার লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হয়েছেন এবং তাদেরই ইচ্ছামাফিক দামে মানুষ চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এই অন্যায় ঠেকাতে সরকারের কি কোনো দায়িত্ব ছিল না?
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির ক্ষেত্রে লোকজনকে সহায়তা করার জন্য একটি কন্ট্রোল সেল খুলে টেলিফোন হটলাইন চালু করেছিল; কিন্তু তা থেকে চামড়া বিক্রেতারা কার্যকর কোনো সহায়তা পাননি। যথাসময়ে চামড়া বিক্রি না হওয়ায় ঢাকা, সিলেটসহ নানা স্থানে অসংখ্য চামড়া নষ্ট হয়েছে। শুধু ঢাকায় ১৫ হাজার নষ্ট চামড়া পুঁতে ফেলার খবর বেরিয়েছে।
বাণিজ্যসচিবের ভাষ্য অনুযায়ী, এ বছর কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় ৩০-৪০ শতাংশ কম পশু কোরবানি হয়েছে। একই কারণে সরকার এ বছর কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বনিম্ন হারে। কিন্তু পশু কোরবানি কম হওয়া এবং কম হারে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া সত্ত্বেও চামড়া বেচাকেনায় এই নজিরবিহীন অন্যায় ঘটেছে এই কারণে যে সরকার শুধু দাম নির্ধারণ আর শেষ মুহূর্তে চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিয়েই দায়িত্ব সেরেছে। চামড়ার বাজারের সংঘবদ্ধ কারসাজি প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয়নি।
কোরবানির চামড়া বেচাকেনার বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে এবং চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারির মালিকদের অসৎ অংশটি সেই
সুযোগ নিয়েছে। কোরবানির সময় কাঁচা চামড়ার বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। নইলে প্রতিবছরই কমবেশি এই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে।