বায়ুদূষণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ। আর সর্বাধিক দূষিত রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। গত রবিবার ঢাকায় বিশ্বব্যাংক ‘ব্রিদিং হেভি : নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সারা দেশের বায়ুমান নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অত্যধিক বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ৭৮ হাজার থেকে ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
২০১৯ সালে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ ছিল বায়ুদূষণ। শুধু মৃত্যু নয়, এ কারণে বহু মানুষ শারীরিকভাবেও অক্ষম হয়ে পড়ে। বহু মানুষের মানসিক অসুস্থতার কারণও এটি। এই দূষণের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন শিশু ও বৃদ্ধ মানুষ, বিশেষ করে যাঁদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় যে ব্যয় হয় তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ। এর পরও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের এত উদাসীনতা কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, দূষণ রোধের ব্যবস্থা ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন বা নির্মাণকাজ, যানবাহনের ধোঁয়া, যত্রতত্র ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকারখানা, আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে বায়ুদূষণের তারতম্য রয়েছে। বাতাসে ভাসমান ২.৫ মাইক্রোমিটারের কম ব্যাসের অতি ক্ষুদ্রকণা (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার বা পিএম২.৫) মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ ক্ষেত্রে একটি মান নির্ধারণ করা আছে, যাকে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইন বা একিউজি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের শীর্ষে আছে ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগে, বিশেষ করে শহর এলাকায় ও ইটভাটার আশপাশে বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা একিউজির তুলনায় ১৫০ শতাংশ বেশি। বায়ুদূষণ কিছুটা কম রয়েছে সিলেট বিভাগে। সেখানেও বাতাসে পিএম২.৫ পাওয়া গেছে একিউজির তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি।
ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে নাগরিকদের উদ্বেগের অন্ত নেই। সভা-সেমিনার-মানববন্ধন করে বায়ুদূষণ রোধের দাবি জানানো হচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকেও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকার বায়ুদূষণ কমছে কি? দেশব্যাপী বৈধ ও অবৈধ ইটভাটা প্রতিনিয়ত বায়ুতে বিষ ছাড়ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নির্মাণকাজেও চলছে যথেচ্ছাচার। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে বালু পরিবহন করার আইন থাকলেও কেউই তা মানছে না। পানি না ছিটিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়াও নগরীর বাতাসে ধূলিকণা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। ঢাকায় কলকারখানাও কম নয়। অথচ বায়ুদূষণ নাগরিকদের শুধু শ্বাসতন্ত্রেরই ক্ষতি করছে না, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ আরো অনেক রোগের কারণ হচ্ছে।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে যত পরিমাণ আইন আছে, পৃথিবীর খুব কম দেশেই তা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে আইন বাস্তবায়নের চিত্রটি ঠিক তার উল্টো। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যদি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়, তাহলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেই হবে। যাদের ওপর আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব রয়েছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।