সাংসদদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। উন্নয়নসহ যেকোনো বিষয়ে নীতি তৈরি করা; উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নয়। ক্ষমতার পৃথক্করণের এই ধারণা সর্বজনীন। এটা দেশ ও সমাজভেদে বদলে যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে হঠাৎই দেখা গিয়েছিল, সাংসদদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। সেটাই ছিল প্রথম সাংসদদের দিয়ে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের টুঁটি চেপে ধরা। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে গত এক দশকে এই ধারার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। এর ফলে স্থানীয় সরকারের অধীনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সাংসদদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধিদের দিয়ে স্থানীয় উন্নয়নের সাংবিধানিক ধারণা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি শুধু সেখানেই থেমে নেই।
সম্প্রতি সংসদীয় আসনভিত্তিক বরাদ্দ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি। এতে যা ফুটে উঠেছে, তা সঠিক হলে এটা সংসদের জন্য অবমাননাকর। পদ্ধতিগত ত্রুটির প্রশ্ন বাদ দিলে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা হলো সাংসদেরা যেখানে সম্পৃক্ত, সেখানে বেশি স্বচ্ছতা, কম অনিয়ম থাকবে। কিন্তু ফলাফল উল্টো।
টিআইবির গবেষণা বলছে, সংসদীয় আসনের সাংসদদের অনুকূলে পল্লি অবকাঠামো উন্নয়নে যেসব কাজ করা হয়েছে, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মান খারাপ। উপরন্তু কাজ থেকে শুরু করে কাজের বিল দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে আছে কমিশন বাণিজ্য।
সার্বিক বিচারে টিআইবির গবেষণা ফলাফলকে জাতীয় সংসদের উচিত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। প্রশ্নবিদ্ধ ভোটের কারণে সংসদের নৈতিক ভিত্তি এমনিতেই প্রশ্নের মুখে। এখন তথ্য বলছে, ছয় শর বেশি প্রকল্পের প্রকৃত বিল ঠিক নয়। এগুলোতে চার থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত দুর্নীতি হতে পারে। সাকল্য দুর্নীতির পরিমাণ ৪১ কোটি টাকার বেশি হতে পারে, এমন অঙ্কও নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে।
সংসদ এখন দুটি কাজ করতে পারে। প্রথমত, অতীতের মতো টিআইবিকে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করে দায়িত্ব শেষ করা। দ্বিতীয়ত, একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা। পঞ্চম সংসদে আমরা একজন মন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে এ রকম তদন্ত কমিটি গঠন, তার ওপরে বিরাট রিপোর্ট প্রকাশ এবং সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সংসদীয় সেই ধারা বেগবান হয়নি, মরে গেছে। কিন্তু তার পুনরুজ্জীবন দরকার।
সবচেয়ে বড় দরকার রাজনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন। সংসদীয় গণতন্ত্রে আশা করা হয় যে রাজনীতিকদের দুর্নীতির শাস্তি চূড়ান্ত অর্থে জনগণের হাতে। কারণ যাঁরা মানুষের চোখে শ্রদ্ধা হারাবেন, মানুষ তাঁদের ভোটে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু ভোটব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে সেই রক্ষাকবচ আর প্রাসঙ্গিক নয়।
আমরা মনে করি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাংসদদের সম্পৃক্ততার নীতি ভুল শুধু নয়, জনস্বার্থের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়। বিশ্বের কোনো গণতন্ত্রেই আশা করা হয় না যে সাংসদ বা মন্ত্রী বা তঁাদের পোষ্যরা কোনোভাবে রাষ্ট্র বা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে বা রীতিবহির্ভূত কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনে যুক্ত থাকুক। সে কারণেই বহু দেশে সাংসদের শপথ নেওয়ার সময় স্বার্থের সংঘাতের বিষয়ে বিবৃতি দিতে হয়। সাংসদদের জন্য লিখিত আচরণবিধি থাকে। এসবের লঙ্ঘনের জন্য সংসদ থেকে তাঁদের অপসারণ করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে যা চলছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সব স্তরের জনপ্রতিনিধিদের জন্য লিখিত আচরণবিধি এবং তাঁদের প্রত্যেকের স্বার্থের সংঘাতসংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হলে পরিস্থিতির কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে। এর প্রতিষেধক রাজনৈতিকভাবে খুঁজে বের করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেশের বর্তমান অবস্থায় শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থার দিকে তাকিয়ে থাকলে উল্লিখিত চিত্র বদলানো কঠিন থেকে যাবে।