মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত ‘কপোতাক্ষ নদ’ এখন মৃতপ্রায়। দখল, দূষণ ও ভরাটের পাশাপাশি অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পকেও এর জন্য দায়ী করা হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, কপোতাক্ষের ওপর নির্মিত সেতুর পিলারের কারণে নদীতে পলি জমে নদী ভরাট প্রক্রিয়া দ্রুততর হচ্ছে। আবার বাইপাস সড়ক নির্মাণের সময় নদের প্রস্থ কমিয়ে ফেলায়ও পলি বেশি জমছে।
এর ফলে নৌযোগাযোগ যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি কপোতাক্ষপারের কয়েকটি উপজেলায় ব্যাপক জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে এই নদ বাঁচানোর পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অনেক সমস্যা থেকেই যায়। সে কারণে ২০২০ সালে ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ২৭.৭৩ শতাংশ। কাজের এই ধীরগতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উত্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণেও প্রকল্পের কাজে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে। জানা যায়, বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশেও ব্যয় সংকোচনের যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে এই প্রকল্প ‘এ’ থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর ফলেও ২৫ শতাংশ ব্যয় হ্রাস করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, কপোতাক্ষ নদ সংস্কারের এই প্রকল্পটি আর ১০টি প্রকল্পের মতো নয়। কপোতাক্ষের জলাবদ্ধতার কারণে এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবনে যে দুর্বিষহ অবস্থা নেমে এসেছে, তা থেকে এই জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রকল্পের আওতায় ছয়টি এলাকায় মোট ২৮২ কিলোমিটার পুনঃখনন ও ড্রেজিং করার কথা রয়েছে। পুনঃখননের পর এই নদের এক পার থেকে অন্য পারের দূরত্ব হবে ৫৫ থেকে ৭০ মিটার। প্রকল্পে পলি ব্যবস্থাপনা, টাইডাল প্রিজম বৃদ্ধি ও নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৩৫ বছর মেয়াদি জোয়ার-ভাটা নদী ব্যবস্থাপনা (টিআরএম) কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। তাই এই প্রকল্প স্থানীয় জনমনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছিল। প্রকল্পের ধীরগতিতে সেই আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে।
দেশ বাঁচাতে হলে নদী ব্যবস্থাপনায় আমাদের আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যে উদ্দেশ্যে কপোতাক্ষ খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, আমরা মনে করি, অতি দ্রুত তা সম্পন্ন করা হবে।