মোঃ রোকনুজ্জামান রোকন: পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন দৃশ্যমান। এর সুবিধাও ভোগ করছে মানুষ। কিন্তু নির্বাচনের আগে থেকেই সরকারকে ভোগাচ্ছিল দ্রব্যমূল্য ও অর্থনৈতিক সংকট। পুনরায় সরকার গঠন করলেও সেই দ্রব্যমূল্য নতুন করে আরও ভোগাচ্ছে। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। সাধারণ মানুষকে যা রেখেছে চরম অস্বস্তিতে। নতুন সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা। এমনটাই মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে নতুন সরকারকে সামনে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ, পণ্যের দাম কমানো। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সব ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হবে।
তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারকে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় নজর দিতে হবে। পদক্ষেপ নিতে হবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভার বাড়ানোর। এজন্য অর্থপাচার বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি। একই সঙ্গে মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
নতুন সরকারের মন্ত্রীরাও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এজন্য সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী, অর্থাৎ কারসাজি চক্র বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কড়া বার্তাও দিচ্ছেন তারা। বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো চক্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ালে তাদের লাইসেন্স বাতিল করার পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়টিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ে পাঁচ মন্ত্রণালয়ের যৌথ বৈঠকের পর সোমবার (২৩ জানুয়ারি) মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি এনবিআরে পাঠানো হয়।
পাশাপাশি খাদ্যপণ্য আমদানিতে যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ডলার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে অন্য মুদ্রায় আমদানির ব্যবস্থা করা হবে। ভোক্তারা যাতে যৌক্তিক মূল্যে পণ্য কিনতে পারেন সেজন্য বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
নতুন সরকার কার্যক্রম শুরু করার পর চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযানের পর চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে যে হারে বেড়েছে, কমার পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম।
সামনে বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ চলমান। মূল্যস্ফীতির চাপ, এটা চলছে। এটা না কমাতে পারলে সব ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হবে। মূল্যস্ফীতি বেশি হলে এক্সচেঞ্জ রেট (মুদ্রার বিনিময় হার) কমবেই। এটা আমাদের কাম্য নয়।’
‘দ্বিতীয়ত বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে হবে। অর্থাৎ, মুদ্রাপাচার কীভাবে কমানো যায়, সেটা দেখতে হবে। নিশ্চয় সেটা সহজ নয়। এটা সামগ্রিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা, আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ কেন বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে? দেশ ছেড়ে গেলে তাদের টাকা তো দেশ ছাড়বেই। আবার করাপশন (দুর্নীতি) বেশি হলে টাকা পাচার বাড়বে এটা স্বাভাবিক। এ জায়গাগুলোতে নজর দিতে হবে।’
আরেক অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ মূলত সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। বিশেষ করে আমাদের বহিঃঅর্থনীতি খাতে যেটা এক্সটার্নাল সেক্টর সেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রার বিনিময়হার স্থিতিশীল করা। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।’
চালের পাশাপাশি অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়েছে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর। এজন্য আসন্ন রমজানে যাতে পণ্যের দাম নতুন করে না বাড়ে তার তোড়জোড় শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়গুলোর মন্ত্রীরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাও করেছেন।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কোনো ব্যবসায়ী সুযোগ নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিল করা হবে এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপরই এখন আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। রোজার আগে যাতে পণ্যের দাম নতুন করে না বাড়ে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুরসহ রমজানের সময় বেশি ব্যবহার হয় এমন আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্যের শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন- সিন্ডিকেট করে কোনো পণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কারা সিন্ডিকেট করে, কারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। কেউ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেললে তার বিরুদ্ধে এবার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের এখন লক্ষ্য রোজার আগে যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম না বাড়ে। ভোক্তরা যাতে যৌক্তিক মূল্যে পণ্য কিনতে পারেন সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। ডলার পাওয়া না গেলে বিকল্প মুদ্রায় আমদানির চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে আপাতত খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের সংকট নেই।
এদিকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান এবং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর সঙ্গে রোববার সন্ধ্যায় এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, রমজানের সময় যেসব আইটেম লাগে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিছু মহল চেষ্টা করে কীভাবে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা যায়। যেখানে মার্কেট ইকোনমি অপারেট করছে সেখানে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। যেভাবে প্রাইস লেভেল ধরে রাখা যায় সে কাজগুলোই সরকার করছে। দরকার হলে আমরা কঠোর পদক্ষেপের দিকে চলে যাবো। কাউকে ছাড় দেবো না।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, বাজারে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির শর্টেজ (কমতি) নেই। কিন্তু কিছু মধ্যস্বত্বভোগী আছে, কিছু মতলববাজ যারা কারসাজি করে তারা আছে। সেই শ্রেণির কৃত্রিম একটি সংকটের কারণে আমরা মাঝে মধ্যে এ ধরনের একটি বিপদে পড়ি। সুতরাং, আপনারা আজ থেকে আশ্বস্ত হতে পারেন, যেসব মেজার্স আমরা কঠিনভাবে নেবো ইনশাল্লাহ আশাকরি শিগগির আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।
কারা বাজার ম্যানুপুলেট করছে তাদের শনাক্ত করা গেছে কি না? জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, বের অবশ্যই করছি। সেই পূর্ণাঙ্গ বের করার ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। চিহ্নিতকরণটা যখন সুনির্দিষ্ট করা যাবে, তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা তথ্য নিয়েছি, রমজানে আমাদের যেসব পণ্যের দরকার হয়, তার কোনোটার ঘাটতি বা সংকট নেই। সব ধরনের পণ্য আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। সুতরাং, আসন্ন রজমানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আমরা আশা করছি। কেউ যদি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২২ জানুয়ারি তৈরি করা তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ, মুগ ডালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ, দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, দেশি হলুদের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, দারুচিনির দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ, লবঙ্গের দাম বেড়েছে ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, এলাচের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং তেজপাতার দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।