প্রায় দুই মাস ধরে কিছুটা স্থিতিশীল থাকা ডলারের বাজারে ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিদেশে রেমিট্যান্সবিরোধী প্রচারণা শুরুর পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে এই মুদ্রার দাম। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪ টাকারও বেশি।
ব্যাংকগুলোও রেমিট্যান্স কেনায় দর বাড়িয়ে ১২০ টাকা করে ডলার কিনছে। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে বেশ কিছু ব্যাংককে বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর ডলারের দাম বেড়ে ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
রবিবার (২৮ জুলাই) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বেশি দামে রেমিট্যান্স আনতে মৌখিক নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করে এমন ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) এ নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণা শুরুর আগে খোলা বাজারে নগদ ডলার বিক্রি হচ্ছিল ১২০ টাকা করে। ব্যাংকগুলো তখন রেমিট্যান্স কেনায় ডলারের দাম দিতো ১১৭ টাকা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষ, কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের প্রেক্ষাপটে চলতি মাসে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণা শুরুর পর থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে একদিনের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। এখন এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১২৪ থেকে ১২৪ টাকা ২০ পয়সা।
আইএমএফের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ মে ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে। এর ফলে এক লাফে প্রতি ডলারে ৭ টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঘোষণা করা হয় ১১৭ টাকা। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের দর নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৮ মে থেকে দুই মাসের বেশি সময় ব্যাংকে ডলারের দর ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় স্থিতিশীল ছিল। তখন খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছিল ১২০ টাকায়।
মতিঝিলের একাধিক মানিচেঞ্জার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা ৫ দিন স্থবিরতা শেষে গত বুধবার (২৪ জুলাই) অফিস খোলার পর ডলারের বাড়তি চাহিদার কারণে দর বাড়তে শুরু করে। ওই দিন খোলা বাজারে প্রতি ডলার ১২১ টাকা থেকে ১২১ টাকা ১০ পয়সায় কিনে তারা বিক্রি করেন ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৪ টাকা ২০ পয়সা।
এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকটি এক্সচেঞ্জ হাউজ সোমবার (২৯ জুলাই) থেকেই রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বেশি নিচ্ছে। তারা ১২০ টাকা ৫০ পয়সা রেটে ডলার বিক্রির অফার করছে।
গত মে ও জুন মাসের পর চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে রেকর্ড রেমিট্যান্স আসছিল। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিন দিনের সাধারণ ছুটিসহ ৫ দিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। এরপর থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ থেকে ২৮ জুলাই ১০ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এর আগে ১ থেকে ১৮ জুলাই এসেছিল মোট ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রথম ১৮ দিনে দৈনিক গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। শুরুর ১৮ দিনের ধারা বজায় থাকলে জুলাই মাসে ২৪৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসতো বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এই অস্থিরতা মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে। এটা কোথায় গিয়ে থামবে, তা আমরা কেউ জানি না। তিনি বলেন, ‘ধারণা করা যায়, ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। এর ফলে অর্থনীতি চরম সংকটে পড়তে পারে।’ তিনি উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলেও সরকার এখন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত।
প্রসঙ্গত, ৮ মে ডলারের দর বাড়ানোর পর মে মাসে ২২৫ কোটি ডলার এবং পরের মাস জুনে ২৫৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। পর পর ওই দুই মাসের রেমিট্যান্স ছিল এযাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালের জুলাইতে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। মূলত ওই সময় করোনায় লকডাউনের সময় হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে বাধ্য হয়ে রেমিট্যান্স পাঠাতেন প্রবাসীরা ।