চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু বেড়েই চলছে। বাড়ির কাছের পুকুরে ডুবে মারা যাচ্ছে একের পর এক শিশু। শিশুদের যেনতেনভাবে খেলতে ছেড়ে দেওয়া ও অভিভাবকের অসচেতনতা এ মৃত্যুর অন্যতম কারণ। বর্ষা মৌসুমে এ ঘটনা বেড়ে যায়। দেড় থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এ সমস্ত শিশু মৃত্যুর স্থান ও সময় ভিন্ন হলেও তাদের মৃত্যুর কারণ একই। পানি থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। ঘটনাস্থলে মারা যায় বেশিরভাগ শিশু।
সর্বশেষ গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলায় তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ৩ জুলাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ মঘাদিয়া এলাকায় পুকুরের পানিতে ডুবে মারা গেছে ফাইজা আক্তার নামের দুই বছরের এক শিশু। সে ওই এলাকার আব্দুল শহীদ বাড়ির মো. আব্দুল গনির মেয়ে। ২৮ জুন উপজেলার মঘাদিয়া ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামে মারা গেছে রুমেল মাহমুদ আলভি নামের দুই বছরের এক শিশু। আলভি কচুয়া গ্রামের কাশেম মেম্বার বাড়ির মেজবাহ উদ্দিন রুবেলের ছেলে। ২৭ জুন উপজেলার ধুম ইউনিয়নের মোবারকঘোনা এলাকায় পানিতে ডুবে মারা গেছে আরশি নামের আড়াই বছরের এক শিশু। আলভি ওই এলাকার ফরায়েজি বাড়ির টিটু ফরায়েজির মেয়ে। এছাড়া ৭ জুন উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে কনক চন্দ্র নাথ নামের দুই বছরের এক শিশু মারা গেছে। কনক ওই গ্রামের বৈষ্ণববাড়ির লক্ষণ চন্দ্র নাথের ছেলে। ৩১ মে উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের কলিম উদ্দিন মহাজন বাড়িতে আদনান সিদ্দিকী আদিব নামে দেড় বছর বয়সের এক শিশু মারা গেছে। আদিব ওই বাড়ির নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী লিটনের ছেলে। ১৫ মে উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের বৈরয়া এলাকায় পানিতে ডুবে বিবি মরিয়ম নামের দুই বছরের এক শিশু মারা গেছে। মরিয়ম ওই এলাকার কবির আহম্মদ ভূঁইয়া বাড়ির ফেয়ার আহমদের মেয়ে।
উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভায় গত ৪ বছরে পানিতে ডুবে অন্তত অর্ধশত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রায় সব শিশুই হাসপাতালে নেওয়ার আগে মারা যায়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম, দুই ঈদ, মা-বাবা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের পূর্ব ইছাখালী এলাকার নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মো. রায়হান নামে সাত বছরের এক শিশু মারা গেছে। রায়হান উপজেলার ৭ নম্বর কাটাছরা ইউনিয়নের ইদিলপুর প্রকাশ কাজী গ্রামের বেপারি বাড়ির মাঈন উদ্দিনের ছেলে। মিরসরাই পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে সাঁতার না জানায় পুকুরের পানিতে ডুবে মারা গেছে কলেজ শিক্ষার্থী আলসামাত মিয়া টিপু। পূর্ব গোভনিয়া গ্রামের সারেং বাড়ির বাছা মিয়ার ছেলে। টিপু মিরসরাই কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ইছাখালী ইউনিয়নের জমাদার গ্রামে পানিতে ডুবে আহমাদ আওসাফ আরাফ নামের এক শিশু মারা গেছে। উপজেলার ৬ নম্বর ইছাখালী ইউনিয়নের জমাদার গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য এমদাদ হোসেনের ছেলে। একই ইউনিয়নের চুনিমিঝির টেক এলাকার মোস্তফা মিস্ত্রি বাড়িতে পানিতে ডুবে রাফিউল ইসলাম সিয়াম নামের দুই বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রাফিউল ওই বাড়ির হুমায়ুন মিস্ত্রির ছেলে। উপজেলার হাইতকান্দি ইউনিয়নের জোড়পুকুরিয়া এলাকায় পুকুরের পানিতে ডুবে মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন নামের এক শিশু মারা গেছে। সাইফুদ্দীন ওই এলাকার লালমিয়া মিঝি বাড়ির নাঈনুদ্দীন চিশতীর একমাত্র ছেলে। উপজেলার ওচমানপুর ইউনিয়নের রোকন্দিপুর গ্রামের সালেহ আহম্মদ সুপারেনডেন্টের বাড়িতে পানিতে ডুবে তাসমিয়া আক্তার নামে পাঁচ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাসমিয়া ওই বাড়ির জাহিদুল ইসলামের মেয়ে।
পানিতে পড়ে মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা গেছে, এখানকার গামীণ জনপদে বাড়িঘর তৈরি হয়েছে পুকুর জলাশয়কে কেন্দ্র করে। বাড়ির পাশের এসব উন্মুক্ত জলাশয়ে নেই কোনো নিরাপত্তায় বেষ্টনী। বলা চলে, এখনো পর্যন্ত উন্মুক্ত পুকুর যে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কেউ তা বিবেচনায় নিচ্ছে না। এছাড়া ঈদসহ বিভিন্ন ছুটিতে শহরের বাসিন্দারা গ্রামে বেড়াতে যায়। তখন শিশুরা পানিতে পড়ে মৃত্যু সংখ্যা বাড়ে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বারইয়ারহাট শেফা ইনসান হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এসএ ফারুক বলেন, পুকুরের পানিতে পড়ে বেশি মারা যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। প্রায় সময় পুকুর থেকে শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনরা। কিন্তু তার আগে তারা মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও খামখেয়ালির কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু বাড়ছে। এটি রোধ করতে অভিভাবকদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখানো হলে এ মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুর রহমান বলেন, পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যু নিয়ে চেয়ারম্যানদের নিয়ে মিটিং করা হবে। একটি প্রজেক্ট তৈরি করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করবো।