নানারকম দূষণ আমাদেরকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তুলেছে। বেঁচে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে দিন দিন ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। চট্টগ্রামে ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা চেম্বার করলেও চিকিৎসার সুযোগ খুব কম। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নেই।
তবে এতকিছুর মধ্যে আশার খবর ক্যান্সারের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নগরীর আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসাপাতালের পাশে এই ক্যান্সার ইনস্টিটিউটটি গড়ে তোলা হবে। এই হাসপাতাল নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় একশত কোটি টাকা। তবে প্রাথমিকভাবে ভবন তৈরিসহ চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করতে অন্তত ৩৫ কোটি টাকার প্রয়োজন। এরমধ্যে এই ইনস্টিটিউটের জন্য অনুদান সংগ্রহের কাজ চলছে। বেশ কিছু সহযোগিতা পাওয়া গেছে।
ইতোমধ্যে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষায়িত এই হাসপাতালের জন্য আট কাঠা মূল্যবান ভূমি প্রদান করেছেন। অনুমোদন মিলেছে পারমাণবিক শক্তি কমিশন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে। হাসপাতালটি চালু হলে ক্যান্সার গবেষণার দুয়ারও উন্মেচিত হবে। মা ও শিশু হাসপাতালের ১০ হাজারেরও বেশি আজীবন সদস্য চান।
চট্টগ্রামের মানুষের ক্যান্সার চিকিৎসায় ভরসা বলতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের মাত্র ৪৮টি শয্যা। নতুন এই হাসপাতাল চালু হলে তা এই অঞ্চলের গরিব ও অসহায় রোগীদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে।
এই ক্যান্সার ইনস্টিউট প্রকল্প বাস্তবায়নে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান, বিজিএমই এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম আবু তৈয়বকে কো চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ গভর্নিং বডির ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আজাদকে সদস্য সচিব করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। দৈনিক আজাদী এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মিডিয়া পার্টনারের দায়িত্ব পালন করবে।
এই উদ্যোগের পেছনে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ গভর্নিং বডির ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আজাদ। তিনি জানালেন, অবকাঠামোগত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে চালু করা যাবে বলে আশা করা যায় এরই মধ্যে ক্যান্সারের ইক্যুপমেন্ট ক্রয়ের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই ইনস্টিটিউট চালু হলে সেবা দানে সহযোগিতার জন্য ঢাকা ক্যান্সার ইনস্টিউটের একদল চিকিৎসক এখানে যোগ দেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
রেজাউল করিম আজাদ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে জন্ম রাউজানের নদিমপুর গ্রামে। তার পিতা ইউনুচ মিয়া একজন সমাজসেবক ছিলেন, তিনি ইউনুচ-আলমাচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ছৈয়দিয়া ইউনুচিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা করেন। পিতার মতো রেজাউল করিম আজাদের সমাজসেবা ও মানুষের সেবা করার ব্রতকে আদর্শ করে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের বৃহৎ চিকিৎসা কেন্দ্রের নানামুখি কর্মকা-ের সাথে তিনি জড়িত রয়েছেন।
আমরা জানি বৈশ্বিক মহামারীতে আজ জনজীবন বিপর্যস্ত। এই সময় এগিয়ে এসেছেন ফ্রন্টলাইনে রেজাউল করিম আজাদ। মা ও শিশু হাসপাতালে খুলেছেন করোনা বিভাগ।
১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কিছু মহৎ প্রাণ সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি বর্গের উদ্যোগে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র শিশু স্বাস্থ্য বর্হিবিভাগের মাধ্যমে এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এটি একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ লাভ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে বর্তমানে একটি ৬৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, একটি ট্রেনিং ইনস্টিউট, একটি নার্সিং ইনস্টিউট, একটি নার্সিং কলেজ, একটি অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট নির্মাণসহ এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ভিলেজে পরিণত হবে। এই উজ্জ্বল স্বপ্ন চট্টগ্রামের বাসীর জন্য কল্যাণের ও আশার।
২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এপ্রিল মাস থেকে দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঠিক তখন থেকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসে। হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির ৪৫৩তম সভায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নতুন হাসাপাতাল ভবনের ২য় ও ৩য় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুত করার গৃহীত হয়। ৩য় তলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয় এবং ১ম পর্যায়ে ৩৪টি শয্যা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়। ২০২০ সালে ৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন হাসপাতাল ভবনে করোনা ইউনিট চালু ও করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা শুরু করা হয়। পরবর্তীতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। ৯২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় আরটিপিসিআর ল্যাব। করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালের উদ্যোগটি সবার কাছে ছিল মাইলফলক। করোনা ইউনিটের জন্য আলাদাভাবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। যা সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সর্বমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নতুন ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় পূর্ণাঙ্গ কার্ডিয়াক ইউনিট ও অত্যাধুনিক ক্যাথ ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চালু হলে চট্টগ্রামে হার্টের রোগীরা কম খরচে এনজিও গ্রাম, এনজিও প্লাস্টিসহ সকল চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। এতে আনুমানিক ৫-৬ কোটি ব্যয় হবে। মেডিকেল যন্ত্রপাতি খাতে ব্যয় হবে ৩-৪ কোটি। এরমধ্যে যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে, কয়েকমাসের মধ্যে তা স্থাপন সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
এই প্রকল্পে সৈয়দ আজিজ নাজিম উদ্দিনকে কো-চেয়ারম্যান, ট্রেজারার মো. রেজাউল করিম আজাদকে মেম্বার সেক্রেটারি ও হাসপাতালের শিশু আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহিম হাসান রেজাকে সমন্বয়কারী করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। মানবিক একপ্রাণ রেজাউল করিম আজাদ এই হাসপাতালকে একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালে পরিণত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হাসপাতালসহ সকল উদ্যোগে তিনি একজন মানবতার প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। গরীব রোগীদের জন্য এই হাসপাতালের দুয়ার সবসময় খোলা রয়েছে। কখনও কোনো রোগী অর্থের অভাবে চিকিৎসা সেবা নিতে অপারগ হলে, তিনি এগিয়ে এসেছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এই প্রশংসায় আগামীদিনে চট্টগ্রামবাসীর সেবার জন্য মা ও শিশু হাসপাতাল অনন্য হয়ে থাকবে।