শফিক আহমেদ সাজীব: বাসদ চট্টগ্রাম জেলার উদ্যোগে আয়োজিত ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট ও উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও সুধী সমাবেশে বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, দেশ আজ এক গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে আজ বিপর্যস্ত। শাসকদল আওয়ামী লীগ উন্নয়নের নানা ফানুস উড়িয়ে জনগণের দূর্বিষহ পরিস্থিতি আড়াল করতে চায়। শাসকদল এককভাবে ক্ষমতার সবটুকু ভাগ-ভোগ নিয়ে চলতে পারবে না। এটা তারা বাইরের চাপে ও দেশের উত্তাপে বুঝতে পেরেছে। তাই জাল জালিয়াতির নব কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। এর বিপরীতে দরকার বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ব্যক্তির ঐক্যমত।
৫ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার নগরের চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের আব্দুল খালেক মিলনায়তনে বাসদ চট্টগ্রাম জেলার উদ্যোগে ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট ও উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও সুধী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বাসদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদ কক্সবাজার জেলার সংগঠক মজিবুল হক, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী দেলেয়ার মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেসাইন কবির, গণমুক্তি ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি রাজা মিয়া।
বাসদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার ইনচার্জ আল কাদেরী জয় এর সভাপতিত্বের এই সুধি সভা পরিচালনা করেন দলটির সদস্য রায়হান উদ্দীন।
সভায় বক্তারা বলেন, চাল, ডাল, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, সিন্ডিকেট কারসাজি, গ্যাস-বিদ্যুত, জ্বালানি তেলের বর্ধিত দাম ও সংকট, লোডশেডিং, পানিসংকটে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্যদিকে একের পর এক সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, ধর্ষণ, নিপীড়নের ঘটনায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন। শাসকদল আওয়ামী লীগ উন্নয়নের নানা ফানুস উড়িয়ে জনগণের দূর্বিষহ পরিস্থিতি আড়াল করতে চায়। আমলাতান্ত্রিক ও দূূর্নীতিবাজ প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্যে জনগণ অসহায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে আজ বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, দেশের টাকা লুট হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৭৩ হাজার টাকা পাচার হচ্ছে যা দিয়ে ৩টা পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব। কেবল ২০২১ সালে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩২১ জন নারী। এর বেশিরভাগেরই সাথে শাসকদলের লোকজন জড়িত থাকায় বিচার হয় নি। কিন্তু সরকারের সমালোচনার ঠিকই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ প্রতিবাদী মানুষজন।
সম্প্রতি নড়াইল, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জসহ সারাদেশে নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছে সনাতনী হিন্দু ও আদিবাসী জনগণ। ঘরবাড়ি, মন্দির পুড়িয়ে নিঃস্ব হয়েছে এই অসহায় মানুষেরা। অথচ প্রশাসন ও সরকার নির্বিকার। উপরন্তু পুলিশের সামনে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে শিক্ষক অবমাননার মতন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতসহ মৌলবাদী দলগুলোর সাথে ক্ষমতাসীনদের আঁতাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাইতো পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িক করার প্রস্তাব, ভাষ্কর্যের বিরোধিতার কাছে সরকারের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে বলেও বক্তারা বলেন।
সরকার উন্নয়নের আওয়াজ প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন
মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী ও দলীয় লোকজনের দাপট ছাড়া কিছুরই উন্নতি ঘটে নি। সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রমাণ হয় মালিকগোষ্ঠীর লোভের কাছে কতটা তুচ্ছ শ্রমিকের জীবন।অন্যদিকে ফসলের ন্যায্যমূল্যের অভাবে, বন্যায় উদ্বাস্তু ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ কৃষক ও সাধারণ মানুষ। এবারের বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ হাওড়ের পানিতে ফসল, গবাদি পশু বাড়ীঘবাড়ীঘর ডুবে গেলেও মেলে নি পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ ও ত্রাণ। অথচ পদ্মাসেতু উদ্বোধনে খরচ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার আতশবাজি।
এবারের বাজেটও উপেক্ষা করা হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনকল্যানমূলক খাতগুলোকে।আমলা তোষণ, কালোটাকার মালিক ও ঋণ খেলাপিদের আরো সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় যতই প্রবৃদ্ধি কিংবা উন্নয়ন হোক না কেন তার ফল কেবল অল্পকিছু মানুষের হাতেই গচ্ছিত হয়। তাই প্রয়োজন সকল বৈষম্য ও শোষণের মূল উৎপাটনের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম জোরদার করা।
বক্তারা বলেন, বর্তমান বিশ্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থাও ক্রমবর্ধমান সংকট ও দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয়ে আছে। পাশের দেশ শ্রীলংকার অর্থনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার ঘটনা থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই ঘনীভূত সংকটের নানাদিক উন্মোচিত করেছে। বাজার দখল,অস্ত্র বিক্রি, জ্বালানি নিয়ন্ত্রণসহ ভূ-আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে মরীয়া হয়ে পড়েছে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, বিপন্ন বসতি, কর্মহীন, গৃহহীন দশায় এই সত্যই তুলে ধরে যে, পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ যতদিন থাকবে মানুষের মুক্তি নেই। এই মানবমুক্তির জন্য, সভ্যতার মুক্তির জন্য শোষণমূলক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে সাম্যের মানবিক সমাজ।
সেই লড়াইকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দেশের জনগণকে আহবান জানান বাসদ নেতারা।