পুরান ঢাকার কদমতলীতে বড় মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুনের হাতে মা, বাবা ও বোনের খুন হওয়ার ঘটনায় নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। পারিবারিক কলহে মা-বাবা ও বোনের ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন মেহজাবিন। তাদের হত্যার পরিকল্পনা করেন ছয়মাস আগেই। পরিকল্পনা অনুয়ায়ী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে একটি-দুটি করে ঘুমের ওষুধ সংগ্রহ শুরু করেন। হত্যাকাণ্ডের দুদিন আগে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে কদমতলীতে মায়ের বাড়িতে আসেন মেহজাবিন। শুক্রবার (১৮ জুন) রাতে সঙ্গে আনা ঘুমের ট্যাবলেট গুঁড়া চা, কফি ও পানিতে মিশিয়ে দেন। সেগুলো খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়লে ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করেন।
রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুর এলাকার বাসায় তিন খুনের ঘটনায় মেহজাবিন মুন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার দায় স্বীকার করে এসব তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনার দুই মাস আগেও মেহজাবিন তরমুজের জুসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পরিবারের সদস্যদের হত্যার চেষ্টা চালান বলে জানায় পুলিশ।
এর আগে গত শনিবার সকালে নিজেদের বাসা থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে তিনজনকে হত্যার কথা জানান মুন। পরে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে তার বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম ও ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে। অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় মুনের স্বামী শফিকুল ও তাদের মেয়ে মারজান তাবাসসুম তৃপ্তিকে। শনিবার রাতে তার বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় হত্যা মামলা করেন তার চাচা সাখাওয়াত হোসেন। এতে তার স্বামী শফিকুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে। পরে চিকিৎসাধীন শফিকুলকেও এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া ছিলেন মেহজাবিন ইসলাম মুন। বাবা মাসুদ রানা বিদেশে থাকায় তাকে শাসন করার মতো কেউ ছিল না। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ অল্প বয়সেই মেহজাবিনকে বিপথে নিয়ে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হওয়া ছিল স্বাভাবিক বিষয়। মেহজাবিন মুনের এই বেপরোয়া জীবনে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার সবাই।
পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে জটিলতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল উল্লেখ করে তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, বিয়ের আগে আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক মেহজাবিন মুনকে প্রাইভেট পড়াতেন। এ সময় ছাত্রীর সঙ্গে তার প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ওই গৃহশিক্ষক ছাত্রীর মা মৌসুমীর সঙ্গেও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দু’জনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ভিডিও করে রেখেছিলেন আমিনুল। সেটি হয়ে ওঠে তার হাতিয়ার। ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে তিনি মা-মেয়েকে জিম্মি করে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি তিনি মেহজাবিনের ছোট বোন জান্নাতুল ও তার এক আত্মীয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই বহুমুখী জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কের একপর্যায়ে মেহজাবিন মুনকে শফিকুলের সঙ্গে বিয়ে দেন মৌসুমী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমিনুল তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও মেহজাবিনের স্বামীকে দেখান। এতে তাদের সংসারে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। অন্যদিকে মৌসুমীও তখন আমিনুলের ওপর বিরক্ত। শেষে শফিকুল, মৌসুমী ও তার এক বোন মিলে আমিনুলকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় মুন আসামি হলেও পরে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ অপর তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।
পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পড়ালেখায় ভালো ছিলেন মুন। এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ ৫ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার মা আগেই দুই মেয়েকে অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে বাধ্য করেছেন। এমনকি পরীক্ষা চলাকালেও তাকে ছাড় দেওয়া হয়নি। এ কারণে এসএসসিতে জিপিএ ৪.৮ পান মুন। কৈশোরে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত করায় তিনি মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আবার তার বাবা মাসুদ রানা প্রবাসে আরেকটি বিয়ে করেছেন, দুই মেয়ের ব্যাপারে তিনি কোনো মনোযোগ দেননি। মায়ের নির্যাতন থেকে মেয়েদের বাঁচাতে কোনো ভূমিকা না রাখায় তার প্রতিও ক্ষোভ জমে ছিল মুনের। আর শ্যালিকা জান্নাতুলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন শফিকুল। এতে সংসার ভাঙার উপক্রম হওয়ায় ছোট বোনকেও দুনিয়া থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন মেহজাবিন মুন। সে অনুযায়ী দুই মাস আগে প্রথমবার তিনি মা-বাবা-বোনকে হত্যার চেষ্টা চালান। সেদিন মা ও বোন ঘুমের ওষুধ মেশানো জুস খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। তবে ডায়াবেটিস রোগী হওয়ায় খেতে রাজি হননি বাবা মাসুদ। ফলে পরিকল্পনা সফল হয়নি।
ওই ঘটনা পর মেহজাবিন সিদ্ধান্ত নেন, এত অল্প মাত্রার ওষুধে হবে না। হত্যা করতে হলে মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। এ কারণে তিনি শুক্রবার দুই মিলিগ্রাম মাত্রার ৪০টি ট্যাবলেটের গুঁড়া পানীয়তে মেশান। অথচ এই ওষুধ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ চার মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেন।
ডিএমপির ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘মেহজাবিনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বাবা দেশে না থাকায় তার মা তাকে এবং তার ছোট বোনকে (নিহত জান্নাতুল) দিয়ে দেহ ব্যবসা করাত। এসব নিয়ে প্রতিবাদও করেছিল সে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’
তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ছোট বোনকে দিয়ে ব্যবসা চলছিল। এর মধ্যে তার স্বামী ছোট বোনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ ছাড়া মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানা ওমানে আরেকটি বিয়ে করেছেন। এসব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকে পরিবারের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে মেহজাবিন পুলিশকে জানিয়েছেন।
তবে নিহতদের স্বজনদের দাবি, মেহজাবিন মুনের একার পক্ষে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়। সঙ্গে তার স্বামী শফিকুলও জড়িত। একই ধারণা পুলিশেরও। কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, ‘মেহজাবিনের স্বামীকেও আমরা সন্দেহের বাইরে রাখছি না। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সম্পত্তির বিষয়ও এখানে রয়েছে। তদন্তে এসব আসবে।’
এদিকে মা, বাবা ও বোনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় মেহজাবিন ইসলাম মুনের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রবিবার (২০ জুন) মুনকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পরিদর্শক জাকির হোসেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।