বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান কেমন করবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ক্রিকেটের বড় বড় বিশ্লেষকরাও কয়েকবার চিন্তা করেন।
পাকিস্তান এবং বিশ্বকাপ-দুটো শব্দ এতোটাই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ যে বিশ্বকাপ এলেই পাকিস্তান দল নিয়ে অন্যরকম একটা আলাপ শুরু হয়ে যায়। যার অনেকটা জুড়েই থাকে-পাকিস্তান কখন কী করে, ঠিক নেই।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হায়দ্রাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামে আজ শুক্রবার শুরু হচ্ছে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ মিশন।
হারশা ভোগলের মতে, “পাকিস্তানকে নিয়ে যত যাই বলি খেলা শেষ হওয়ার আগে কিছুই বোঝা মুশকিল, এতোটাই অননুমেয় একটা দল পাকিস্তান। এই সেদিন এশিয়া কাপে এল মনে হচ্ছিল তারা চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে।”
জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকবাজে পাকিস্তান ক্রিকেট দল নিয়ে নিজের বিশ্লেষণ বলছিলেন হারশা। এশিয়া কাপে পাকিস্তান হয়েছে চতুর্থ দল।
পাকিস্তানকে নিয়ে বিশ্লেষকরা যতোই আশাবাদ ও শঙ্কার কথা বলেন, পাকিস্তানের কড়া সমর্থকদের মনে থাকে কাপ জয়েরই স্বপ্ন, কারণ দলটার নাম পাকিস্তান।
এবারও পাকিস্তান কাপ জিততেই ভারতে পা দিয়েছে, বাবর আজম ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগেই জানান দিয়েছেন, “সেমিফাইনাল পাকিস্তানের জন্য একটা ছোট স্বপ্ন”।
অর্থাৎ কাপ জিতে ফিরতে চান পাকিস্তানের অধিনায়ক, যার অধীনে পাকিস্তান দল সফল, অনবদ্য এবং ধারাবাহিক।
গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজ থেকে শুরু হয় পাকিস্তানের জয়যাত্রা, এর মাঝে ২৫ ম্যাচে মাত্র ছয়টিতে হেরেছে পাকিস্তান।
এর মধ্যে পাকিস্তান আইসিসি র্যাংকিংয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের এক নম্বর দলের জায়গাও দখল করেছিল কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু শঙ্কার জায়গা এটাই যে পাকিস্তানের এই ছয় হারের মধ্যে দুটি এসেছে সবশেষ এশিয়া কাপে। তাও আবার ভারতের বিপক্ষে ২২৮ রানের ব্যবধানে।
এই ম্যাচে পাকিস্তানের শীর্ষ তিন পেসার শাহীন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ, হারিস রওফ তিনজনই ছিলেন। এশিয়া কাপে সুপার ফোর পর্বে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত হয়েছে চার নম্বর দল, এরপর সোজা বিশ্বকাপে এসেছে পাকিস্তান।
এখানে প্রস্তুতি ম্যাচে প্রথমে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরেছে। যদিও গা গরমের ম্যাচ তবুও পাকিস্তান জয় পেলে যে স্বস্তিটা পেতেন বাবর আজম সেটা এখন অনুপস্থিত।
ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ, যেখানে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলে না পাকিস্তান প্রায় ১০ বছর ধরে, শেষবার ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কোনও ক্রিকেট দল ভারতে গিয়েছিল, পারিপার্শ্বিক নানা বিষয় বাবর আজমরা এড়িয়ে যেতে পারেন কিন্তু ভারতের মাটিতে ক্রিকেট খেলতে নেমে একটা প্রচ্ছন্ন চাপ থাকবেই পাকিস্তান দলের ওপর, এখন দেখার বিষয় সেই চাপে পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেবে নাকি এবার বিখ্যাত ৯২ ফিরিয়ে আনবে ভারতের মাটিতে।
পাকিস্তানের ব্যাটিং ভালো-মন্দ মিলিয়ে
পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম এখন বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে ইনফর্ম ব্যাটারদের একজন, ক্রিকেট উপস্থাপক হারশা ভোগলের মতে, ‘বাবরই এখন বিশ্বের সেরা সীমিত ওভারের ব্যাটার’।
এই বছর ১৬ ম্যাচে প্রায় ৫০ গড়ে সাড়ে সাতশোর মতো রান তুলেছেন বাবর। গত বিশ্বকাপ থেকে হিসাব করলে বাবরের গড় ৬০ এরও বেশি।
হারশা ভোগলের মতে বাবরের দিকেই তাকিয়ে থাকবে পাকিস্তান, বিশ্বকাপে পাকিস্তান ভালো করবে কি না, এটা পুরোপুরি নির্ভর করবে বাবর আজম কেমন বিশ্বকাপ কাটাচ্ছেন।
বাবর আজমও বিষয়টা ভালোভাবেই অবগত, যে এবারের বিশ্বকাপ তার জন্য একটা বড় পরীক্ষা। এমন একটা দেশে খেলতে গিয়েছেন যেখানে গিয়ে খেলাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ সাথে যোগ হয়েছে বিশ্বকাপ জয়ের চাপ, সব মিলিয়েই পাকিস্তানের জন্য একটা কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তবে পাকিস্তান ক্রিকেট দলটা ঐতিহাসিকভাবেই কঠিন পরিস্থিতি ভালোবাসে এবং চাপের মধ্যে পারফর্ম করাটা পছন্দ করে।
সেক্ষেত্রে কিছু জায়গায় তাদের দুর্বলতা ঢাকতে হবেই, যেমন বাবর আজমের সাথে মোহাম্মদ রিজওয়ান দারুণ ফর্মে আছেন, ইমাম উল হক খুবই ভালো ব্যাট করছেন কিন্তু ফখর জামান এখন একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি কিছুদিন আগেও আইসিসি র্যাংকিংয়ে ওয়ানডে ব্যাটারদের মধ্যে সেরা দশে ছিলেন।
শেষ দশ ম্যাচে ফখর ২০০ রানও করতে পারেননি, এপ্রিল মাসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা তিন সেঞ্চুরি ও অপরাজিত ১৮০ রানের ইনিংসের পর ফখর আর ৪০ রানও স্পর্শ করতে পারেননি কোনও ওয়ানডে ইনিংসে।
হারশা ভোগলে মনে করেন, আব্দুল্লাহ শফিক পাকিস্তানের বড় সম্পদ হতে পারেন, তাকে টপ অর্ডারে জায়গা দেয়ার পক্ষে এই বিশ্লেষক।
তবে হারশার মতে পাকিস্তানের মূল উদ্বেগের জায়গা মিডল অর্ডার ও লোয়ার মিডল অর্ডার।
পাকিস্তানের দুশ্চিন্তা লোয়ার অর্ডার ও স্পিন বোলিং
রিজওয়ান ছাড়া বাকিদের ওপর বিশ্বকাপ জেতার মতো ভরসা কি রাখতে পারেন? এই প্রশ্ন তুলেছেন এই ক্রিকেট উপস্থাপক ও বিশ্লেষক।
সালমান আঘা, সউদ শাকিলরা বিশ্বকাপে বাবরকে কতোটা সমর্থন দিতে পারবেন এটার ওপর নির্ভর করবে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ যাত্রা। তবে পাকিস্তানের লোয়ার মিডল অর্ডারের অবস্থা বেশ করুণ।
মোহাম্মদ নাওয়াজ শেষ ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ৭২ রান, শাদাব খান ১১ ম্যাচে ১৩৮ রান।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের টপ অর্ডার কোনও কারণে বিশেষ কোনও দিন ব্যর্থ হলে লোয়ার মিডল অর্ডারের ওপর আস্থার জায়গাটা এখন কম। এটাই এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
গত বিশ্বকাপ থেকে এই বিশ্বকাপের মাঝের সময়টাতে পাকিস্তানের মোট রানের ৫৮ শতাংশ এসেছে টপ অর্ডার থেকে, যা ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ।
তবে এখানে ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারেন ইফতিখার আহমেদ, এই হার্ড হিটিং ব্যাটসম্যান যে কোনও ম্যাচে প্রভাব ফেলতে পারেন, এই বছর ইফতিখারের ব্যাট থেকে ৩৪৮ রান এসেছে, গড় প্রায় ৭০, স্ট্রাইক রেট ১১৪ এর মতো।
আবার এই ক্রিকেটাররাই আরও একটা দুর্বলতার সাথে সংশ্লিষ্ট সেটা হচ্ছে স্পিন বোলিং, নাওয়াজ ও শাদাব দুজনই স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার, দুজনেরই চলতি বছর বোলিং গড় ৪০ এর মতো, যা গড়পড়তা বোলারদের থেকেও খারাপ।
লেগস্পিনার উসামা মিরকে স্কোয়াডে রেখেছে ম্যানেজমেন্ট কিন্তু অভিজ্ঞতার দিক থেকে তিনি বেশ পিছিয়ে, তিনি আট ম্যাচ বল করেছেন ৩৫ গড়ে তবে নাওয়াজ ও শাদাবের চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি এই বছর।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বরাবরই মাঝের ওভারগুলোতে খেলার গতিপথ নির্ধারিত হয়, এই সময়টায় মূলত চতুর্থ ও পঞ্চম বোলাররা বল করেন, কখনো কখনো পার্ট টাইম বোলাররাও ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করেন।
এখানে বাবর আজমকে বেশ বেগ পেতে হবে, কারণ পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার যদি তিনজন খেলে তাদের ওপরই প্রত্যাশা থাকবে বেশি, স্পিনারদের ফর্ম খুব একটা ভালো নয় এবং ২০-৪০ ওভারের মধ্যে তারা নিয়মিত উইকেট তুলে নিতে পারছে না সাম্প্রতিক সময়ে।
গত বিশ্বকাপের পর থেকে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের স্পিন বোলারদের গড় খারাপের দিক থেকে দুই নম্বরে, কেবল জিম্বাবুয়ের চেয়ে ভালো গড় পাকিস্তানের স্পিনারদের।
ফাস্ট বোলিংটা পাকিস্তানের বরাবরই ভালো
পাকিস্তান ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য বিখ্যাত এক দেশ, বরাবরই এমন সব ফাস্ট বোলার এই দেশ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উঠে এসেছেন যারা প্রতিপক্ষের মনে ভীতি জাগিয়েছেন। এবারও পাকিস্তানের পেস বোলিং ত্রয়ী তৈরি করেছিলেন শাহীন আফ্রিদি-নাসিম শাহ-হারিস রউফ। কিন্তু এশিয়া কাপে চোটের কারণে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে গিয়েছেন নাসিম শাহ।
নাসিম শাহ’র জায়গায় দলে ঢুকেছেন অভিজ্ঞ হাসান আলি। এটা পাকিস্তানে সামগ্রিক বোলিং লাইন আপকে খানিকটা দুর্বল করেছে এটা সত্য তবুও পাকিস্তানের এই বোলিংও প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের জন্য কঠিনই হবে, বিশেষ করে প্রথম দশ ওভার।
হারশা ভোগলে নিজের বিশ্লেষণে বলেছেন, “শাহীন আফ্রিদি পাকিস্তানের জন্য শুরুতে উইকেট এনে দিতে পারলে তিনিই হবেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার”।
কিন্তু শাহীন শুরুতে উইকেট না পেলে পাকিস্তানের বোলিং বেশ নখদন্তহীন মনে হয় বলছেন হারশা। হারিস রউফের গতি আছে কিন্তু তিনি বেশ খরুচে বোলার ১৩ ম্যাচে ২৪ উইকেট নেয়া হারিস চলতি বছর ওভারপ্রতি ছয়ের কাছাকাছি রান দিয়েছেন।
আবার শাহীন শাহ আফ্রিদি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নতুন বলে যতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন, বল পুরনো হলে তাকে ব্যাটাররা তুলনামূলক সহজে খেলেন।
পাকিস্তানের ক্রিকেটের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাঠে নামার পর অনেক সময়ই অনেক সমীকরণ বদলে দিতে পারে দলটি, গত বিশ্বকাপেও পাঁচ ম্যাচে জয় পেয়ে নেট রান রেটে নিউজিল্যান্ডের থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল। সেবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে হারিয়ে দিয়েছিল সরফরাজের পাকিস্তান।
২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে শুরু করেও ফাইনালে উঠেছিল।
এবারও ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন প্রেডিক্ট করছেন, নেদারল্যান্ডসের কাছেও হেরে যেতে পারে, আবার অনেকের মতে ফাইনালেও উঠতে পারে, দলটার নাম যে পাকিস্তান।