সিলেটে পুলিশের হেফাজতে রায়হান আহমদ হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ ও মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী। আর আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম।
আদালতের আদেশের বিষয়টি জানান অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে রায়হানকে হত্যা করেন অভিযুক্ত আসামিরা। আসামিদের একজন মামলার অভিযোগ গঠন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। আদালত আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন। এর ফলে এই মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হতে আইনগত কোন বাধা থাকল না।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর রাতে সিলেট নগরের আখালিয়ার এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমেদকে ধরে এনে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আটকে রাখেন এস আই আকবর হোসেন ভুইয়ার নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পরে ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের কাছে দশ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না চাওয়ায় এসআই আকবরের নেতৃত্বে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। নির্যাতনে ১১ অক্টোবর পুলিশ ফাঁড়িতেই রাতে মারা যান রায়হান। এ ঘটনায় পরদিন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি মামলা করেন।
এ ঘটনায় ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর পুলিশি হেফাজত থেকে কনস্টেবল হারুনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রধান অভিযুক্ত আকবরকে ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে ২০২১ সালের ৫ মে এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পিবিআই। এতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে (৩২) প্রধান আসামি করা হয়। অন্যরা হলেন- সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী (৪৩), কনস্টেবল মো. হারুন অর রশিদ (৩২), টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), এসআই মো. হাসান উদ্দিন (৩২) ও এসআই আকবরের আত্মীয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমান (৩২)। নোমান এখনও পলাতক।
মামলার তদন্ত শেষে ছয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/ ৩৪ ধারায় এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের ১৫(১)(২)(৩) ধারায় চার্জশিট দাখিল করে পিবিআই। চার্জশিটে যুক্ত ময়নাতদন্ত রিপোর্টে চিকিৎসকরা মত দিয়ে বলেছেন, রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ওই চার্জশিট আমলে নিয়ে গত বছরের ১৮ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত। অভিযোগ গঠনের পর রায়হানের স্ত্রী, মা, পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যগ্রহণের এক পর্যায়ে মামলার আসামি বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্য কনস্টেবল হারুন অর রশিদ অভিযোগ গঠন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের পাশাপাশি দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগ গঠন আইনানুগ হয়নি। অভিযোগ গঠন আদেশ বাতিল করা হোক।
শুনানিতে এই আবেদনের বিরোধিতা করে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ভিকটিমকে নির্যাতন করে হত্যা করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এ কারণে তদন্ত রিপোর্ট দুই আইনে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বিচারিক আদালত সঠিকভাবে অভিযোগ গঠন করেছে। এতে আইনের কোন ব্যতয় হয় নাই। এছাড়া ৪৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ পর্যায়ে বিচারের হস্তক্ষেপ করা হলে ন্যায় বিচার বিঘ্নিত হবে। শুনানি শেষে হাইকোর্ট আবেদনটি খারিজ করে দেয়। আসামি পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, বিচার শেষ পর্যায়ে। হয়ত আগামী মাসেই এই মামলার বিচার শেষ হতে পারে।
সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি নওশাদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ৪৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মোট সাক্ষী রয়েছে ৬৯ জন। এখন চিন্তাভাবনা করছি আর কতজনের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আবেদন করব। তবে আমি আশা করছি এ বছরই এই মামলার বিচার শেষ হবে।