বিরূপ আবহাওয়ার কারণে চলতি বছর বিশ্বে চাল উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতসহ এশিয়ার শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। বলা হচ্ছে, এর ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারি এবং সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এরই মধ্যে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি তৈরি করেছে। এ অবস্থায় চালের উৎপাদন হ্রাস সমস্যাকে প্রকট করে তুলতে পারে।
এশিয়ার দেশগুলো বিশ্বের মোট চালের ৯০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। বিশ্বের সর্বাধিক ধান উৎপাদনকারী পাঁচ দেশের চারটি হলো ভারত, চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম।
উল্লেখ্য, ভারত গত বছর এককভাবে যে পরিমাণ চাল রপ্তানি করেছে সেটি তার পরবর্তী চার শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত রপ্তানির চেয়ে বেশি ছিল।
ভারতের বেশি ধান উৎপাদনকারী এলাকাগুলোয় এবার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। চীনেও দাবদাহ চলেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বন্যার কারণে ধানের উৎপাদন কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
রয়টার্সের ওই প্রতিবেদন বলছে, গত দুই বছরের ব্যাপক ফলন এবং রপ্তানিকারকদের বড় মজুদের কারণে চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এবার উৎপাদন হ্রাস পেলে বিশ্ববাজারে নতুন সংকট তৈরি হবে।
ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংকের কৃষি অর্থনীতিবিদ ফিন জিবেল বলেন, প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে চালের বাজার বাড়ার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।
জিবেল আরো বলেন, ‘উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে খাদ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা দুরূহ হয়ে উঠেছে। চালের দাম বাড়লে তা সেই অবস্থা আরো খারাপ করে তুলবে। ’
ভারতের আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশটির প্রধান ধান উৎপাদনকারী রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশে এ বছর এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে দেশটির চাল রপ্তানিকারকদের সংগঠনের সভাপতি বিভি কৃষ্ণ রাও জানান, এ বছর চাল উৎপাদন কমতে পারে ১৩ শতাংশ। এই আশঙ্কা সত্যি হলে ভারতে এবার আগের বারের চেয়ে এক কোটি টন কম উৎপাদিত হতে পারে।
এ অবস্থায় ভারত সরকার চাল রপ্তানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তারা এই পথে হাঁটতে পারে। মুম্বাইয়ের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘দাম সামান্য বেড়ে গেলেও সরকারকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পথে যেতে হতে পারে। ’
ভিয়েতনামের ব্যাক লিউ প্রদেশের কৃষক ত্রান কং দাং বলেন, ‘ফসল কাটার মুহূর্তে এত বৃষ্টিপাত আগে কখনো দেখিনি। এটা অস্বাভাবিক। ১০ দিনে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তা আগের পুরো মাসের বৃষ্টির সমান। ’ প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যায় এই কৃষকের দুই হেক্টর জমির ধানের ৭০ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
বিশ্বে চালের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক চীন। ভোক্তা হিসেবে আমদানির পাশাপাশি তারা ব্যাপক হারে চাল উৎপাদনও করে। কিন্তু সেখানে প্রচণ্ড দাবদাহে এবার ধানের চাষ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ বলছে, উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীনের চাল আমদানির পরিমাণ রেকর্ড ৬০ লাখ টনে পৌঁছতে পারে। বছরখানেক আগে যা ছিল ৫৯ লাখ টন।
চালের তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ বাংলাদেশ। বন্যার কারণে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় তারাও আমদানির কথা ভাবছে।
ভারত ছাড়া বাকি দেশগুলোর ঘাটতির চিত্র এখনো সেভাবে সামনে আসেনি। সাধারণত বছরের শেষ দিকে এসব হিসাব প্রকাশ করা হয়। তবে ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে আনা রপ্তানির চালের দামে বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব এ সপ্তাহেই বোঝা যেতে পারে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক চাল ব্যবসায়ীদের একজন বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার আশঙ্কার বিষয়টি আমরা এরই মধ্যে বুঝতে শুরু করেছি। ক্রেতাদের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফিলিপাইন ও আফ্রিকা থেকে কার্গো বুক করা হচ্ছে। ’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর অর্থনীতিবিদ শার্লি মুস্তাফা বলেন, ‘ভারত, চীন, বাংলাদেশসহ কয়েকটি প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর আমরা দৃষ্টি রাখছি। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উৎপাদন কমতে পারে। ’