এম বুরহান উদ্দীন: ঝিনাইদহে আকস্মিক শিলাবৃষ্টিতে বিভিন্ন ধরনের ফসলের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছে ড্রাগন ফলের বাগান। বৃষ্টিতে মসুরি, গম, ভুট্টা, ধান, আম ও লিচুর পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা ড্রাগন বাগানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ড্রাগনচাষিরা এ ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
গত রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ১০ মিনিটের শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে ৩ হেক্টর জমির ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ড্রাগন ফলের ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন চাষিরা। এ ছাড়া জেলায় ৭১৮ হেক্টরের বেশি পরিমাণ জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কৃষকের পক্ষে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে ড্রাগন বাগানগুলোকে ভালোভাবে পরিচর্যা করলে ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে।
আরও জানা যায়, জেলায় ৫২ হাজার ১২২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ করা হয়েছে। গত রোববারের শিলাবৃষ্টির কারণে ৭১৮ হেক্টরের বেশি জমিতে ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের মধ্যে ৪ হাজার ২৭৮ হেক্টর গমের মধ্যে ১১২ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৭ হাজার ৭৯১ হেক্টর ভুট্টার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৮৬ হেক্টর, ১০ হাজার হেক্টর পেঁয়াজের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ হেক্টর, ৭ হাজার ৪৬৯ হেক্টর মসুরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩ হেক্টর, ৪৫২ হেক্টর মটরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হেক্টর, ২ হাজার ৫৭১ হেক্টর রসুনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হেক্টর, ২১৮ হেক্টর ধনিয়ার মধ্যে ৮ হেক্টর, ১৫১ হেক্টর ড্রাগনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হেক্টর, ৫ হাজার ৫৯৫ হেক্টর কলার মধ্যে ২ হেক্টর, ১ হাজার ৫৬২ হেক্টর আলুর মধ্যে ৫ হেক্টর, ১৫৬ হেক্টর ফুলের মধ্যে ২ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আম, লিচু, টমেটোসহ সব ধরনের ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে বলেও জানা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার ২৫ হেক্টর জমির মধ্যে কৃষ্ণপুর গ্রামের মাঠে ৬ থেকে ৭ জন কৃষকের আকস্মিক এই শিলাবৃষ্টিতে ৩ হেক্টর জমির ড্রাগন বাগান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিলাবৃষ্টির আঘাতে গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো ভেঙে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। অনেক গাছ থেকে শাখাগুলো ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। শিলার আঘতে গাছগুলোতে পচন দেখা দিয়েছে। বাগানগুলো রক্ষার্থে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বাগানমালিকরা। ড্রাগন বাগানের পাশপাশি মসুর, গম, ভুট্টা, ধান, আম ও লিচুসহ ৭১৭ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে শাকসবজিরও।
কৃষক রহিম উদ্দিন জানান, কৃষ্ণপুর মাঠ থেকে এক বিঘা জমিতে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রয় করেছেন চাষিরা। হঠাৎ শিলাবৃষ্টিতে ধানসহ ড্রাগন বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দু-এক বছরের মধ্যে এই ক্ষতি কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
ড্রাগনচাষি আব্দুর রশিদ জানান, তিনি বছর ধরে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ করছেন। প্রথম বছরে বাগান প্রস্তুত করতে সিমেন্টের খুঁটি, ড্রাগন চারা, তারকাঁটার বেড়া, সার ও অন্যান্য খরচসহ বিঘাপ্রতি ছয় লাখ টাকা করে খরচ হয়েছিল। দ্বিতীয় বছর সার, কীটনাশক ওষুধ, শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য খরচসহ দুই লাখ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। প্রথম বছরে তেমন ফল না এলেও দ্বিতীয় বছর থেকে এক বিঘা জমিতে ছয় লাখ টাকার বেশি ড্রাগন বিক্রি করেন তিনি।
এবার বিঘাপ্রতি সাত লাখ টাকা বিক্রির টার্গেট ছিল। কিন্তু হঠাৎ শিলাবৃষ্টিতে সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে তার। এখন সরকারের স্বল্প সুদে ঋণ ও আর্থিক প্রণোদনা পেলে স্বাভাবিকভাবে আবারও এই বিদেশি ফল চাষ করতে পারবেন বলে মনে করেন তিনি।
কৃষ্ণপুর গ্রামের ড্রাগনচাষি রবিউল ইসলাম জানান, তিনি আগে গাড়ির ব্যবসা করতেন। ইতালিপ্রবাসী চাচার পরামর্শে ৬ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। গত মৌসুমে ১৫ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছেন। এ বছর ৪০ লাখ টাকার টার্গেট ছিল। কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে ড্রাগন বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর গাছে ফল আসবে না। আবার নতুন করে পরিচর্যা করে আগামী মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকার সহজ শর্তে ঋণ ও আর্থিক সহায়তা দিলে নতুনভাবে বাগান শুরু করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহিদুল করিম বলেন, সদর উপজেলায় ২৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন বাগানের মধ্যে ৩ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষক সামনে দেড় মাস সময় পাবেন। এ সময়ের মধ্যে সঠিকভাবে ড্রাগনের পরিচর্যা করলে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব।