গোলাম রব্বানী শিপন, বগুড়া প্রতিনিধিঃ দেশে ক্রমাগত ভাবে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে বগুড়ায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে পড়েছে ৪ শিক্ষার্থীর তরতাজা প্রাণ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শুধু কি নিহত হচ্ছে? দুর্ঘটনার পাশাপাশি যে বেঁচে যাচ্ছে সেও গুরুতর আহত ও সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করছে।
আর কত প্রাণ ঝরলে, আর কত মানুষের রক্তে সড়ক-মহাসড়ক রঞ্জিত হলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কমবে? দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার-পরিজনের হৃদয় বিদীর্ণ করা আহাজারি আর কত দেখতে হবে? সচেতন মানুষের মনে এসব প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কুরবানি ঈদের ছুটিসহ গত কয়েক দিনে সড়ক-মহাসড়কে যে হারে দুর্ঘটনা ঘটছে, তা প্রত্যক্ষ করে বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া যেন আর কিছু করার থাকছে না।
পত্র-পত্রিকা গুলোর অধিকাংশেরই শীর্ষ সংবাদ ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের আহত-নিহতের সংবাদ। মহাসড়ক মৃত্যুফাঁদ, রক্তাক্ত মহাসড়ক, এ ধরনের শিরোনাম পড়ে হৃদয়-মন ব্যথিত না হয়ে পারে না। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে সড়ক-মহাসড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে অল্প বয়সে কিশোরদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, সড়কের খানা-খন্দ ও বিপজ্জনক মোড়। বহু লেখালেখি হলেও এসব কারণ প্রতিকার করা দূরে থাক, দিন দিন দুর্ঘটনার ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে।
এরই মধ্যে বগুড়ায় সাম্প্রতিক ভয়াবহ ২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪শিক্ষার্থীর প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।
জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার দিকে সদর উপজেলার কালিবালা দ্বিতীয় বাইপাসে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাক ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
নিহত শিক্ষার্থীরা হলেন, বগুড়া সদরের ধরমপুর ওলিরবাজার এলাকার আলহাজ কাজলের ছেলে রেদোয়ান মিয়া (১৭) ও একই এলাকার শাহিনুর শেখের ছেলে সাদিক শেখ (২০)।
রেদোয়ান ও সাদিক মোটরসাইকেলে করে মাটিডালীর দিকে যাচ্ছিলেন। পথে কালিবালা এলাকায় ঢাকাগামী কাঁচামালবাহী একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে তাদের মোটরসাইকেল দুমড়ে-মুচড়ে ঘটনাস্থলেই সাদিক ও রেদোয়ান নিহত হন।
এদের মধ্যে রেদোয়ান বগুড়া এপিবিএন স্কুলের এবং সাদিক নুনগোলা কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। একই ভাবে গত শনিবার ২৩ জুলাই বগুড়ার শাজাহানপুরের ঢাকা-রংপুর ২য় বাইপাস মহাসড়কে ট্রাক ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- শহরের দক্ষিণ চেলোপাড়া এলাকার খোকন মোহন্তের ছেলে সাগর মোহন্ত (২১) এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জামিরতা এলাকার আলমাসের ছেলে তানভীর হোসেন (২১)। আহত হয় তাদের বন্ধু সানি নামের আরও এক শিক্ষার্থী। তারা ৩জনই বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ৫ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ওই দুর্ঘটনার কারন হিসেবে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অনুমান করা যায়, ৩ বন্ধু মিলে মোটরসাইকেল চেপে বগুড়ার দ্বিতীয় বাইপাস সড়ক ধরে মাটিডালীর দিকে যাচ্ছিলেন। আর শেরপুরের একটি খালি ট্রাক বেতগাড়ী লিচুতলার দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে নিশ্চিন্তপুর এলাকায় পৌঁছালে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার মাঝখানে পড়ে গেলে ট্রাকের নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই তানভীর মারা যান। পরে সানি ও সাগরকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিলে সেখানে সাগরের মৃত্যু হয়।
নিরাপদ সড়ক চাই বগুড়া জেলা শাখার একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতের বেশির ভাগই কিশোর যাদের বয়স ২০ বছরের মধ্যে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অনেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে অথবা প্রভাবশালী পরিচয়ে রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে দাপিয়ে বেড়ান।
নিরাপদ সড়ক চাই বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি রোটাঃ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিরাপদ সড়ক চাই বগুড়া জেলা কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের টিম বগুড়া জেলা শাখা মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের হেলমেট পড়তে উৎসাহিত করছে। সড়কে যানজট মুক্ত সহ দুর্ঘটনারোধে চালক ও পথচারীদের সচেতন করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বাড়ছে। এটা একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেলের ব্যবসা করতে যেয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার জনসম্পদ নষ্ট হচ্ছে। সরকারের উচিত গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে বগুড়ার সড়ক মহাসড়ে যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা।
বগুড়ার বিআরটিএ এর এক কর্মকর্তা বলেন, গঠনগত ভাবে মোটরসাইকেল অপেক্ষাকৃত একটি অনিরাপদ বাহন। এটি সাধারণত যুবক বা উঠতি বয়সীরা বেশি ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা খুব বেশি। সম্প্রতি দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
দেশের সড়কগুলো এখনও উচ্চ সিসির মোটরসাইকেলের জন্য উপযুক্ত নয়। এমনিতে দুর্ঘটনার শীর্ষে মোটরসাইকেল। চালনায় অদক্ষতা, দ্রুতগতিতে চলাচল, হাইওয়েতে নিয়ন্ত্রণহীন মোটরসাইকেল। এরই মধ্যে মোটরসাইকেলের সিসি বাড়ানো হলে বাড়বে দুর্ঘটনাসহ মৃত্যুর ঝুঁকি।
নিরাপদ সড়ক চাই বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রকিবুল ইসলাম সোহাগ বলেন, বেশ কয়েকটি জরিপে দেখেছি, মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পড়লে মৃত্যুর ঝুঁকি ৭০ শতাংশ আর আহত হওয়ার হার ৪০ শতাংশ কমে যায়। ”কিন্তু সমস্যা হলো বাজারে মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় যেসব হেলমেট বা সেফটি গার্ড বিক্রি হয়, সেগুলো কতটা মানসম্পন্ন সেই প্রশ্ন আছে। ফলে দেখা যায়, হেলমেট পরার পরেও হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বড় কারন অল্প বয়সী ছেলেদের বেপরোয়া গতিতে চালানো। এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকেরা সন্তানদের নিয়ে আগামী দিনের কথা চিন্তা করে কমবয়সী ছেলেদের বাইক না দেওয়া।